১৯৩৫ সাল। মানে আজ থেকে ৮৪ বছর আগে; তখন অবধি ‘ভরতপুর’ দুঃষ্মন্তের অবৈধ সন্তানের মতই, ‘ডাক শুটিং রেঞ্জ’ হয়ে লালমুখোদের জীঘাংসা নিবৃত্তির কাজ করে এসেছে। এলাকাবাসীদের ভাষায় ‘ঘনা’ বন, যার মাঝে ‘কেওলাদেও’-এর মন্দির আছে, সেটাকে খুব একটা পাত্তা কেউই দিত না।
কিন্তু ১৯৩৫ সালে একটা বিপত্তি ঘটল। মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া একজন শীর্ণকায় খ্যাপাটে বৃদ্ধ লোক এসে জুটল এই ‘ঘনা’ বনে। চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে সেই যে জঙ্গলে ঘোরা শুরু হল, সেই ঘোরা শেষ হয় একেবারে তাঁর দেহান্তরের পড়ে।
হ্যাঁ ৫২ বছর ধরে তিনি অবশ্যই শুধুমাত্র ভরতপুরেই ঘুরে বেড়ান নি, কিন্তু ১৯৮২ সালে জাতীয় উদ্যান এবং ১৯৮৫ সালে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ আখ্যা পাওয়ার পেছনে তাঁর অবদান সিংহভাগের বেশীই বলা যেতে পারে।
তিনি, সেলিম আলি। ছোটবেলায় ভুল করে একটা ‘ইয়োলো থ্রোটেড স্প্যারো’ মেরে ফেলার পর, পাখিতে কৌতুহল জাগার সেই গল্পটা আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু এটা মাঝে মাঝে ভুলে যাই, একটা লোক, সারাজীবন জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছে শুধু পাখির পেছনে, শুধু পাখিকে ভালোবেসে, শুধু প্রকৃতিকে ভালোবেসে।

এসব লোককে আজকের সমাজ কি বলে জানেন তো? কোন লেবেল গায়ে লটকায়?
“পাগল !”
-“লোকটা কাজ ফেলে দিনরাত শুধু পাখির পেছনে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর বৌয়ের অন্নধ্বংস করছে দু’বেলা…”
এই হল সমস্যা, বুঝলেন ? লোকটা কাজ করেছে, মশাই… কাজ। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, দিনের পর দিন রাতের পর রাত কাজের কাজ করেছে। সেই কাজ, যেটা আপনার অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মনের স্বপ্ন হতে পারে, কিন্তু পেটে টান পড়লে, আপনিও সেই স্বপ্ন বাপ বাপ করে সটান পরিত্যাগ করবেন। স্কুলের পরে আর পড়াশোনা করা হয়নি, আর তাই জীবনে বাধাও পেয়েছেন পদে পদে, কিন্তু এস ডিলন রিপ্লে যখন “বার্ডস অফ ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট” নামক মহাভারত রচনায় নামেন, তাঁকেও কিন্তু আসতে হয় এই তথাকথিত ‘অশিক্ষিত’ মানুষটিরই কাছে।
আজ তাই, কেওলাদেওর জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে চোখের কোণে আনমনেই দু’ফোঁটা জল চলে এল… এই রাস্তায় একদিন এই মহান ব্যক্তির, মহান বিজ্ঞানীর, মহান পরিবেশপ্রেমীর পায়ের ধুলো পড়েছিল। সেই রাস্তায় হাঁটার আমার ঠিক কতটা যোগ্যতা আছে ?
আমার মতন নাস্তিক, দু’কানকাটা ছেলের জন্য, এটাই তীর্থস্থান… এগুলোই স্বর্গ… আর তাই আমি ভন্ড তপস্বীর মত বার বার ছুটে যাই ভরতপুর, সুলতানপুর…
আজ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতির জন্য একটা লম্বা লেন্স হাতে আমি হয়তো অনেক অনেক পাখির ছবি একদিনেই পেতে পারি, কিন্তু সেটা কি পাখি, চেনার জন্য বাড়ি গিয়ে খুলতে হবে ‘দ্য বুক অফ ইন্ডিয়ান বার্ডস’ লেখক, সেই আলি সাহেব। একদিন, ক্যামেরা ছাড়া, শুধু একটা দুরবীন চোখে লাগিয়ে তিনি এই পাখিদের দেখে দেখে তাদের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণণা লিখে গেছেন, ডাক, গায়ের রঙ, ঠোঁটের আকার…
জানি, সেই ক্লাস নাইন থেকেই পাখি পাখি করে নিজের, এবং বাড়ির সবার মাথা খারাপ করেছি, হয়তো ভবিষ্যতে আরও করব, কিন্তু মাফ করবেন আলি সাহেব, এই ভরতপুরে বসে স্বীকার করছি, আমার আর পাগল হওয়া হল না; এই মিডিওক্রিটির যুগে, শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের ‘অ্যাপ্রুভাল’ খুঁজেই এই জীবন কেটে গেল।
“সেলিম আলি, একটাই জন্মায় রে হতচ্ছাড়া…”
এটা আমি বললাম না… কেওলাদেওর প্রতিটা পাখির ডাকে আমি আজ শুধু এই কথাটাই শুনতে পেলাম…
শান্তির আশায়…
নীল…