মা জগদ্ধাত্রীর, এবং শ্রী শ্রী সেমেস্টারের কৃপায় গত শনিবার লিবারিশ অনুপস্থিত ছিল, এই একটি সপ্তাহের জন্য ক্ষ্যামাঘেন্না প্রার্থনা করি…
ক’দিন ধরে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছি। মানে যদি ব্লগের শেষ কয়েক’টা পোস্ট লক্ষ্য করি, তাহলে দেখব বিজেপি সরকার কে গালি দিয়েছি, বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির খুঁত ধরেছি, ইত্যাদি ইত্যাদি। আজ নীজেরই কেমন মনে হল, তাহলে কি অন্যরকম লেখা আর আমার দ্বারা হচ্ছে না ? তাহলে কি শুধু লোকের খুঁত ধরেই লিবারিশের পথ চলবে? এইসব ভাবতে ভাবতেই এই লেখার অবতারণা।
তাই, আজ বরং অন্য কিছু হোক…
আজ একটা অন্য আঙ্গিকে সম্পর্কের কথা নিয়ে আলোচনা করা যাক। হ্যাঁ, জানি ব্যাপারটা পাকাচুল কোনো প্রফেসারের একটা গম্ভীর একঘেয়ে লেকচারের প্রথম বাক্য বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু আদপে সেরকম কিছু আমি বলতে চাই না…
আচ্ছা, সম্পর্ক বলতে আমরা কতরকমেরই সম্পর্ক বুঝি? বাবা-মা-ভাই-বোন-প্রেমিকা-স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে… সবক’টাই তো সম্পর্ক; আর সব সম্পর্কেরই আলাদা কিছু দিক আছে, কিছু দাবী আছে, আর অনেক অনেক দায়িত্ব আর প্রত্যাশা আছে…
আমি আমার অনেক লেখাতে আমার বাবার কথা অনেক গুছিয়ে বলেছি; বাবা-ছেলের সম্পর্কের এক একটা দিক ফুটে উঠেছে, অন্যভাবে। কিন্তু কথা হল, যারা শুধু আমাকে লেখা পড়েই চিনেছেন, তারা নিশ্চয়ই মনে করবেন, আমি আমার বাবার বেশী ন্যাওটা; কিন্তু আসলে, সেটা একেবারেই নয়। আমার ছোট ছোট অভিযোগ থেকে ছোট ছোট লুকিয়ে রাখা কথা, প্রথম প্রেম থেকে স্কুলে পেন-টিফিনবক্স হারিয়ে আসা, সব ব্যাপারেই আমার মায়ের কাছে মুখ খুলেছে সবার আগে, এবং খুলতে দ্বিধাও হয়নি একবারও।
তাই, মায়ের সাথে আমার সম্পর্কটা যেমন অত্যন্ত গভীর, তেমনই অত্যন্ত সাধারণ। কিন্তু বাবার সাথে আমার যে যে ঘটনা বা পরিপ্রেক্ষিতে মনের বাঁধনটা শক্ত হয়েছে, সেগুলো এতটাই অন্যরকম আমার কাছে, তাই বাবার সাথে আমার সম্পর্কের এই অম্লমধুর ব্যাপারটার সৃষ্টি হয়েছে। হ্যাঁ, আমার বাবা বড্ড মাথাগরম লোক, এটা সবাই জানে, হ্যাঁ, বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে হয়তো ৩০০ দিনই আমাদের ঝগড়া বা মনোমালিন্য হয়ে থাকে। কিন্তু যদি ভাবতে বসি, তাহলে আমি পরিষ্কার বুঝতে পারি, আমি কতটা প্রভাবিত বাবার দ্বারা। হয়তো তাঁর ভালো স্বভাবগুলোর চেয়ে খারাপ স্বভাবগুলোই(যেমন, মাথা গরম) আমি বেশী পেয়েছি বা, বাবার ভাষায় ‘রপ্ত করেছি’; কিন্তু তাঁর ওই গুটিকতক স্বভাবের জন্যই আজ আমি, ‘আমি’ হতে পেরেছি।
আসল কথা হল, আমি জানি আমার বাবা (এবং মা) কেউই আদর্শ মানুষ নয়, এবং আমিও নই। কিন্তু নিজের এবং নিজের কাছের লোকগুলোর দোষটা জানা, স্বীকার করা এবং এটা জেনেও তাদের সাথে একাত্ব হয়ে থাকাতেই জীবনের সার্থকতা বলে আমার মনে হয়।

আসলে, জীবনের প্রতিটা সম্পর্ককেই হয়তো নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। আর সেই সংজ্ঞায়নের মধ্যেই সেই সম্পর্কের মূলকথা লুকিয়ে থাকে। যেমন ধরুন, ‘প্রেম’। প্রেমের মতো গোলমেলে শব্দ বোধহয় পৃথিবীতে আর তৈরী হয়নি। এই একটি সম্পর্ককে বোধহয় সবথেকে বেশীভাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে; ‘ভালোবাসার অনেক নাম’। তাই প্রেম কারোর কাছে ভিক্টোরিয়ায় বাদামভাজা, আর কারোর কাছে একটা দামী স্কচের বোতল। প্রেমিকার হাতে মারধোর খাওয়াটাকেও কেউ উপভোগ করেন, আবার কারোর কাছে লংড্রাইভই হল উপভোগ্য।
স্ট্যানলি ক্যুব্রিক, তাঁর শেষ ছবি ‘আইজ ওয়াইড শাট’-এ একটা খুব ভালো প্রশ্ন তুলেছিলেন। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ঠিক কাকে বলে?
মানে, যে লোকটি স্ত্রী-এর পাশাপাশি ‘উপপত্নী’তে মন দিচ্ছেন; তিনি লম্পট, চরিত্রহীন, অন্তত সমাজ তো তাই বলে। কিন্তু ধরুন, একটি লোক, যিনি কিনা তাঁর বিবাহিত জীবনে সুখী নন, মানসিক ভাবে একা, রাস্তায় একটি সুন্দরী মেয়েকে দেখে যৌনকামনায় পাগল হয়ে গেলেন, কিন্তু কিছুই করতে পারলেন না, শুধু বুকভরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ি ফিরে গেলেন।
তিনি কি দোষী নন? চরিত্রহীন নন? না, কারণ সমাজ বলছে না।
অনেকে বলে থাকেন, ‘পুরুষ মাত্রই বহুগামী’।
হ্যাঁ, হতে পারে। হয়তো তাই-ই। আসলে পুরুষ-নারী, সবার মনটা কিন্তু একটা পাগলা ঘোড়ার মত। মনের ঘোড়ার গলায় লাগাম না পড়ালে সে যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে ছুটতে পারে। এবার সেটা মনের স্বভাব- আর সেটাই ঠিক, এটা অনেকেই মনে করেন।
কিন্তু, আমার প্রশ্ন হল, মনের গলায় লাগাম না পড়ালে, অনেককিছুই ঘটতে পারে। আর সেই তালিকায় সন্ত্রাসবাদ থেকে ধর্ষণ, সবই পড়ে। কারণ আমাদের মনকে মানানো, বা মানুষ করা একমাত্র আমাদেরই কাজ।আমাদের মন আমাদের প্রথম সন্তান। এবার সেই সন্তানকে আমরা যদি আলালের ঘরের দুলাল করে তুলি, তাহলে একদিন সে এমন গর্হিত কোনো কাজ করতে চাইবে, যেটা দাঁতে দাঁত চেপেও আমরা আটকাতে পারব না।
তাই হয়তো পুরুষদের ক্ষেত্রে বহুগামীতা সহজাত; কিন্তু শুধু নিজের মনের কথা শুনে, মনের মর্জিমাফিক চলতেই তো আসিনি আমরা; অন্তত আসা উচিত নয়; তাই শুধু আমাদের আশেপাশের মানুষগুলোর কথা ভেবেই মনের গলায় লাগাম পড়ানো উচিত আমাদের। সম্পর্কের জন্য, সম্পর্কের কাছে মাথা নোয়ানোর মধ্যে কোন ভুল বা নীচতা তো আমি দেখি না।
স্কুল পেরোতে পেরোতে বন্ধুত্বের মধ্যেও বদল আসে। স্কুলের টিফিনের ভাগ দিতে দিতে আপনি মাথা তুলে দেখবেন, সবাই বড় হয়ে গিয়েছে, আর বড় বড় চাহিদার ঝুলি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অবাক লাগে। যখন যে বন্ধু ভুল করলে একদিন মাথায় একটা চাঁটি মরলেও সে কিছু মনে করত না, আজ সে আপনার শুভাকাঙ্ক্ষাকে তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে মনে করছে। অনেকে হয়তো পারে, কিন্তু আমি পারি না, আর তাই কোনো বন্ধুর সামনে ‘তোর জন্য এই এই করেছি’ বলে একটা বিরাট বড় তালিকা ঝুলিয়ে দেওয়ার স্বভাব আমার আজও হয়নি। তাই আমি একটা খুব সোজা হিসেব মেনে চলি, চাহিদার ঝুলি হাতে যেই আসুক না কেন, আমার ঝুলি আমি কারোর সামনে মেলে ধরব না। কারণ অন্যের ঝুলি ভরতে কেউ চায় না; আর সম্পর্ক যেখানে দেনা-পাওনার হয়ে যায়, সেখানে বন্ধুত্বের অন্তরাত্মা প্রাণত্যাগ করতে বাধ্য।
আবার অনেকে মনে করেন আমার সদ্ভাব বজায় রাখা দরকার, সবার সাথে; তা না হলে সমাজ কি বলবে…
আমি তাতেও বিশ্বাস করি না। প্রথম তো আমি সমাজের কথায় ওঠা বসা করার ঘোর বিরোধি, আর আমি আরো বিরোধি তাদের, যারা সমাজের এইসব নৈমিত্তিকতাকে মাথায় তুলে নাচে আর অনেক নিয়ম বিনাকারণে ভেঙ্গে দাবী করে তারা সমাজের উর্দ্ধে বসবাস করে।
আর এটা মানি না বলেই আজ আমার কোনো বন্ধু নেই। কারণ আমার বন্ধুত্বের ‘সংজ্ঞা’ কারোর সাথেই মেলে না, মেলা সম্ভবও নয়। সত্যি কথা বলতে কি, যারা নিজেদের সমাজোর্ধ মনুষ্বোত্তর জীব মনে করে, তারা যে তাদের ভুল স্বীকার করতে নারাজ হবে, এটা জানা কথা।
এত কথা লেখার একটাই কারণ, আজকাল সম্পর্কে জটিলতা আর কৃত্রিমতা দু’টোই হু হু করে বেড়ে চলেছে। আর আমার মনে হয়, এটা নিয়ে আমাদের অনেক ভাবনা চিন্তা করার দরকার আছে। কারণ একটা জন্তুও জন্মায়, খায় দায়, বংশবৃদ্ধি করে, আর শেষে মরে যায়… কিন্তু মানুষকে মানুষ তৈরী করে তার সম্পর্কগুলো, তার প্রেম, তার ভালোবাসা…
তাই এখনো সময় আছে। আপনার কাছের মানুষটির কথা ভাবুন, দোষ স্বীকার করুন, কাঁদুন… আপনার বন্ধুর কাছে হিসেব না চেয়ে, তার পাশে থাকুন… ঝুলিটা না হয় খালিই রইল…
শান্তির আশায়,
নীল…