এবার পুজোয় তিনটে সিনেমা দেখতে যাওয়ার অনেকগুলো কারণ ছিল। কিশোর কুমার জুনিয়র দেখতে যাওয়ার কারণ কৌশিক গাঙ্গুলি এবং প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি-এর কারণ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। আর এক যে ছিল রাজা… সত্যি কথা বলতে সৃজিত মুখুজ্জে আমার কাছে অনেকটা ফরেস্ট গাম্প-এর ‘জেনি’-এর মতন হয়ে গেছে। মানে ‘আনফেথফুল ইয়েট ভেরী অ্যাট্রাক্টিভ এক্স গার্লফ্রেন্ড’। যাই হোক। বাংলা সিনেমার রিভিউর সামনেই এরকম ইংরেজী গুঁজে দিলে ব্যাপারটা খুব একটা শোভন হয় না। পঞ্চমীর দিন দেখেছি ‘কিশোর কুমার জুনিয়র’, সপ্তমীতে ‘এক যে ছিল রাজা’ আর দ্বাদশীর দিন মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি। তা যে সিকোয়েন্সে সিনেমাগুলো দেখেছি, সেইভাবেই আলোচনাটা শুরু করি।
প্রথমেই আসি ‘কিশোর কুমার জুনিয়র’-এর কথায়। তিনটে সিনেমার মধ্যে, এটার ওপরই আমার সবথেকে বেশী ভরসা ছিল। সিনেমা হলে ঢুকে বসার পর থেকে শুরুটাও মন্দ হয়নি। মদে চুর প্রসেনজিৎ স্টেজে টলতে টলতে উঠে মাইক হাতে ধরেই অন্য মানুষ, পা টলছে না, গলা কাঁপছে না… আর সারা রাস্তা আবার মদ্যপান করতে করতে মাতাল হয়ে বাড়ি ঢুকে হল্লা করা। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ করার কোনও অবকাশ নেই। কবে ‘মায়ের আঁচল’ আর ‘বাবা কেন চাকর’-এ কি করে এসেছেন, সেটা মনে পড়ে না আজকের এই প্রসেনজিৎ কে দেখলে। প্রথম আধঘন্টা বাবা-মা-ছেলের সম্পর্কের উত্থানপতন; শিল্পীর তথা কন্ঠী-শিল্পী হওয়ার জ্বালা, সবকিছু মিলিয়ে একটা অম্লমধুর ফ্যামিলী ড্রামার মশলা পাচ্ছিলাম। কিন্তু পাকিস্তান বর্ডারে শান্তির জন্য দুই দেশীয় কনসার্টে ডাক পাওয়ার পর থেকেই ছবির গল্প দিশা হারালো। ছিল শিল্পীর স্ট্রাগলের গল্প, তার মধ্যে হিন্দু-মুসলিম, ভারত-পাকিস্তান সব মিলিয়ে মিশিয়ে একটা সাড়ে-বত্রিশ ভাজার দিকে যেতে গিয়ে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাঠ ময়দান হয়ে গেল। এতগুলো বিষয়কে স্থান দিতে গিয়ে এত প্লট পয়েন্টের আমদানি করতে হয়েছে, তা অনেকক্ষেত্রেই বাড়াবাড়ির পর্যায় চলে গেছে। কিশোর কুমার জুনিয়রের ট্রুপের বাঁশীবাদক লামাকে তাই হঠাৎই রফিকন্ঠী হয়ে উঠতে হয়েছে। নিপাট গৃহবধূ অপরাজিতা আঢ্যকেও প্রাক্তন কন্ঠশিল্পী হয়ে আত্মপ্রকাশ করতে হয়েছে সিনেমার প্রয়োজনে। তাই গল্পটা শেষমেষ থর মরুভূমির মাঝে গিয়ে পথ হারিয়েছে।
তবে এতকিছুর মধ্যেও পাওনা হল আমাদের প্রসেনজিৎ, অপরাজিতা এবং রাকেশ শর্মার অভিনয়। পাকিস্থানী সহানুভূতিশীল ডাকাতের ভূমিকায় রাকেশ শর্মার চরিত্রটি অত্যন্ত সুন্দর ভাবে তৈরী। প্রাক্তনের মতই একজন আটপৌড়ে গৃহবধূ হিসাবে অপরাজিতা আঢ্য খুবই সাবলিল, কিন্তু বাংলার পরিচালকরা তাকে ‘টাইপকাস্ট’ করতে শুরু না করলেই ভালো, অন্য ধরনের চরিত্রে ওনাকে দেখতে পেলে ভালো লাগবে।
তার সাথে লামা এবং প্রসেনজিতের ইম্পালসিভ ছেলের ভূমিকার ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়ের অভিনয়ও বেশ ভালো।
তবে, অবশ্যই; সিনেমার ১৮টা গানের ব্যাপারে কিছু না বললে অপরাধ হবে। যে কারণেই হোক, কুমার শানু বাংলার চেয়ে হিন্দি গানগুলো অনেক ভাল গেয়েছেন। তার গলায় ‘কুছ তো লোগ ক্যাহেঙ্গে’ বা ‘ও সাম কুছ অজীব থি’ বেশ ভালো লাগে। তবে কৌশিক চক্রবর্তীর (সঙ্গে তার পৃথিবী ব্যান্ড) গাওয়া ‘চলো উড়ে যাই’ এবং ‘সেদিনো আকাশে ছিল কত তারা’ নজর কাড়ে।
এবার আসি এক যে ছিল রাজার কথায়। সপ্তমীর দিন নাইট শো তে দেখবার পড় অনেকগুলো ব্যাপার আমার মনে হয়, সেগুলোই বলি।
প্রথম, সিনেমাটা যেভাবে মার্কেটিং করা হয়েছে, সেটা নিয়ে আমার অনেক আপত্তি আছে। ‘মিসলিডিং’ কথাটা খুব পুরোনো, কিন্তু খুব সত্যি। আমি সন্ন্যাসী রাজা-এর কথা তুলছি না, বা তুলনাও টানছি না। সিনেমটাকে বার বার বলা হয়েছে ‘যে কথা কেউ জানে না, কোনো সিনেমাতে নেই, আসল কেস ফাইল ঘেঁটে’। এবার একটা কথা বলি, একবার গুগল করুন ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসী’ বলে। উইকিপিডিয়ার যে পেজটা খুলবে, সেটা আপাদমস্তক পড়লে বুঝতে পারবেন, তার এক লাইনের বেশী কিন্তু সিনেমাটাতে নেই। তাহলে? উইকিপিডিয়া পড়া আর কেস ফাইল খোলা কি এক হল?
দ্বিতীয়ত, সিনেমাতে দেখানো হয়েছে, বিক্রমপুরের মেজোরাজকুমার দুশ্চরিত্র, লম্পট, এবং সেই বিষয়টাকে অত্যন্ত বড় করে দেখানো হয়েছে, যে উত্তরাধিকার মানেই কি একজন দুশ্চরিত্র, লম্পট কিন্তু প্রজাবৎসল রাজাকে তার রাজ্য (এবং রানী) ফিরিয়ে দেওয়া হবে?
খুবই ভালো এবং মানবিক প্রশ্ন। এবার এক মাস আগে বেরোনো ট্রেলারটা দেখুন। সেখানে দেখতে পাবেন, রাজার পরিচয় দেওয়া হচ্ছে ‘Benevolent King’, ‘Loving Brother’, ‘Ladies’ Man’…
‘Ladies Man’ ?
আচ্ছা ‘চার্মিং’ আর ‘লম্পট’ কি এক কথা হল?
না, গোটা সিনেমা জুড়ে সৃজিতবাবু প্রমাণ করলেন যে রাজা একজন জঘন্য চরিত্রের লোক, যিনি প্রজাদের প্রতি যত্নবান হলেও, নিজের স্ত্রীর প্রতি একেবারেই ছিলেন না। মদ, বেশ্যা আর শিকার করে দিন কাটাতেন। সেই তিনি ট্রেলারে ‘লেডিজ’ ম্যান’ হয়ে গেলেন? যদি গোটা সিনেমা ধরে পরিচালক রাজার নৈতিক চরিত্র ধ্বংস করতেই ব্যস্ত থাকলেন, তাহলে ট্রেলারে তিনি ‘লেডিজ’ ম্যান’ কেন? কেন ‘শেমলেশ ওম্যানাইজার’ নন?
তার কারণ লেডিজ’ ম্যান যত দর্শক টানবে, ‘ওম্যানাইজার’ টানবে না। তাই ট্রেলারে এই তথাকথিত ‘সুগারকোটিং’-এর ব্যবস্থা…
‘হয় হয়, zনতি পারো না…’
গোটা সিনেমাটার ট্রেলারে, টিসারে বার বার করে ফিরে এসেছে সাহানা বাজপায়ীর গলায় ‘মহারাজ, একী সাজে…’ গানটি। রাজার জীবন, মেহফিলের চাকচিক্য, দেখাতে গিয়ে কিন্তু অনেক অনেক শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। যেখানে গোটা গল্পের সাথে ‘মহারাজ…’-এর সম্পর্ক অনেক কম। কিন্তু সেই গোটা সিনেমার মার্কেটিং করা হল শুধুমাত্র একটি গান দিয়ে। কারন,
১) গানের প্রথম লাইন ‘মহারাজ, একী সাজে…’ আর সিনেমার নাম ‘এক যে ছিল রাজা’
২) সিনেমায় রবীন্দ্রসংগীত আজও বাঙালিকে একটা অন্য ধরনের সুড়সুড়ি দেয়।
সিনেমার শ্রেষ্ঠ গান আমার মনে হয়েছে ‘সমারহী, এসো হে…’ আর সত্যি কথা বলতে ‘মহারাজ…’ গানটা যেন বড্ড তাড়াহুড়ো করে গাওয়া বলে আমার মনে হয়েছে।
গোটা সিনেমার তিনটে অংশ ছিল, রাজার জীবন, সন্ন্যাসীর জীবন এবং সবশেষে কোর্টের মামলা। এখানে কোর্টের মামলা গোটা গল্পের সূত্রধর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলাফল, তিনটে আধাখাঁচড়া গল্পকে জোড়া হয়েছে রদ্দি এডিটিং দিয়ে; হ্যাঁ, সস্তার, রদ্দি এডিটিং দিয়ে। যেখানে দু’টো শট পর পর রিপিট হচ্ছে, কন্টিনুইটি বোঝানোর জন্য। অঞ্জন দত্ত এবং অপর্ণা সেন তাঁদের সীমিত স্ক্রীন-টাইমে যথাযথ; কিন্তু তাঁদের মধ্যে একটা প্রাক্তন সম্পর্ক আর পরিত্যক্ত ট্রামের মধ্যে বসে আলোচনা, না ঢোকালেই চলছিল না?
আসল মামলার দুই পক্ষের পুরুষ উকিলের বদলে রানীর পক্ষে অপর্ণা সেনকে এনে গল্পে যে মাত্রাটা আনার চেষ্টা করা হয়েছে, সেটা নিয়ে কোনো আপত্তি নেই আমার। কিন্তু, দুই উকিল ঠিক কতটা যুগোপযোগী? মানে আমি জানি না সেযুগে মহিলা ব্যারিস্টার ঠিক কতজন ছিলেন (আদৌ ছিলেন কিনা); তা না হলে তিনি খাঁটি ফ্রেঞ্চ লবজই বা জানলেন কোথা দিয়ে(টুশে!); আর তাঁর বিপক্ষের উকিলই বা কি করে ‘ফেলেশিও’, ‘ক্লিটোরাল অর্গাজম’ ইত্যাদি টার্ম জেনে ফেললেন? যতদুর জানি, কামসূত্রের ইংরেজী অনুবাদ তখনও বাজারে আসেনি, আর অঞ্জন দত্ত এখানে উকিল, ডাক্তার নন। এই ডায়ালগগুলো শুধু শুধু অপ্রাসঙ্গিকই নয়, আমার অত্যন্ত খেলো লেগেছে। কেমন যেন মনে হয়েছে, কতগুলো যৌনতা সম্পর্কিত টার্ম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, অকারণে।
যেমনই অপ্রাসঙ্গিক লেগেছে বাঈজির সাথে ‘স্ট্রীপ পোকার’… থুড়ি, স্ট্রীপ দাবা খেলার দৃশ্য। শুধু খোলা পিঠ আর চুমু দেখালেই যদি বাংলা সিনেমা সাবালক হতে পারত, তাহলে তো মিটেই যেত। এসব অপ্রাসঙ্গিক দৃশ্যই বার বার প্রমাণ করে দেয়, যে বাংলা সিনেমা এখনো তার বয়ঃসন্ধি কালেই আটকে রয়েছে।
সিনেমাটোগ্রাফি আহামরি কিছু নয়, বাহিরদৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মত ‘ভিসুয়াল ট্রীট’-ও নয়।
আর একটা ব্যাপার বাদ পড়ায় আমি অবাক হয়ে গেলাম। অপর্না সেন যখন বলছেন ‘ইনি পঞ্জাব প্রদেশের মাল সিং নামের এক প্রতারক, কোনভাবেই বিক্রমপুরের মেজোকুমার নন’, কোথাও দেখানো হচ্ছে না মাল সিং নামটা এল কোথা থেকে? আসল মামলার কাগজ কিন্তু বলছে, ভাওয়াল সন্ন্যাসীর গুরু ধর্মদাস নাগা নিজে বলেছিলেন কথাটি, এবং তারপর তিনি আদালতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন, এবং তাই তার সাক্ষ্য বাতিল হয়ে যায়। ধর্মদাস নাগার সাক্ষী দেওয়া দেখানো হল, কিন্তু এরকম একটা জরুরী ঘটনার কোনো উল্লেখ পেলাম না।
দ্বিতীয়ত, মেজোকুমার বঙ্গালী উপভাষায় কথা বলতেন, আর ভাওয়াল সন্ন্যাসী হিন্দী-উর্দূ, এবং ব্রজবুলিতে। একবারও বলা হল না, স্মৃতিভ্রংশের পর তিনি শুধু হিন্দি আর উর্দু শুনেছেন বলে বাংলা ভুলে গেছেন। এবং সেটা স্বাভাবিক, সব কিছুর সাথে ভাষাজ্ঞানটাও ফিরে আসে না।
হ্যাঁ, অনেক্ষণ ধরে অনেক নিন্দা করলাম, অনেকেই বাছা বাছা গালি নিয়ে তৈরী হচ্ছেন। এবার তাহলে ভালোর কথায় আসি। সিনেমা হলে যদি দেখতে যান, যাওয়ার আগে ভুলে যান, সৃজিত মুখার্জীর সিনেমা দেখতে চলেছেন। ভাবুন যীশু সেনগুপ্তের সিনেমা দেখতে চলেছেন। কারণ এটা যীশুর জীবনের সেরা অভিনয় বললে অত্যুক্তি করা হবে না। রাজা থেকে সাধু, দৈহিক এবং মানসিক তফাতটা থেকে শুরু করে সংলাপ বলার পরিবর্তন; সবকিছুতে হয়তো নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়েই করেছেন, এবং যা করেছেন, সেটা অসধারন।
জয়া এহসানও খুব ভাল, শুধু অভিনয় করার সুযোগ পেলেন না অনির্বাণ ভট্টাচার্য্য। বড্ড ছোট হয়ে গেল ওনার চরিত্রটা। অঞ্জন দত্ত এবং অপর্ণা সেনের কথা নতুন করে বলবার কিছু নেই।
তাই সবশেষে আবারও বলব, যীশু সেনগুপ্তের নজরকাড়া অভিনয় এই ছবির সবথেকে বড়, এবং হয়তো একমাত্র সম্পদ।
এবার আসি দ্বাদশীর কথায়। সত্যি কথা বলতে, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প নিয়ে সিনেমা করা ব্যাপারটা খানিকটা হিট-অর-মিস ধরনের। নবীগঞ্জের দৈত্য অবলম্বনে তপন সিংহের পরিচালনায় ‘আজব গাঁয়ের আজব কথা’ আর পড়ে অভিজিৎ চৌধুরীর ‘পাতালঘর’, দুটো সিনেমাই বেশ ভালো ছিল, কিন্তু একেবারেই মন কাড়েনি ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’ আর ‘সাধুবাবার লাঠী’।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘অদ্ভুতুড়ে’ সিরিজের গল্পগুলো ছোট থেকেই আমি গোগ্রাসে গিলেছি। কিন্তু ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ একটা আলাদা জিনিস ছিল। গল্পটা যতবারই পড়ি বা পড়েছি কখনোই পুরোনো হয়নি। কিন্তু গল্পটার সমস্যা হল, বহু চরিত্র, এবং ঘটনার ঘনঘটা, এবং গোটা গল্পটা দিন দিয়েকের মধ্যেই শেষ। তাই লেখকের ন্যারেটিভটা রুপোলী পর্দায় তুলে ধরা অত্যন্ত কঠিন কাজ। মনে হতে পারে গোটা গল্পটা যেন হুশ হুশ করে চোখের সামনে দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে। এবং হলও তাই। লেখকের ন্যারেটিভ সিনেমার পর্দায় ধরতে গিয়ে একটা ছড়ানো ছিটানো গল্প পাওয়া গেল। কিন্তু তবু, এই তিনটে সিনেমার মধ্যে মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি-কে সবার আগে না রেখে পারছি না।
কেন? কারণটা খুব সোজা। শীর্ষেন্দুর গল্পের যে মূল উপাদান, ফ্লেভার, সেইগুলো এই ছবিতে অটুট। সিনেমাটা আমার ভালো লেগেছে, কারণ গল্পটা পড়তে পড়তে যেখানে যেখানে আমার প্রচন্ড হাসি পেয়েছে, সিনেমাতেও সেই জায়গাগুলোতেই আমার হাসি পেয়েছে। কাকের গলায় পৈতে, ঠাকুরঝির গোবরে পড়ে যাওয়া থেকে কিরমিরিয়ার বিলাপ। আমার ছোটবেলাটাকে চোখের সামনে জ্যান্ত দেখতে পেয়ে আমার এবং পাশে বসা বাবার মুখে যে হাসিটা ফুটে উঠেছিল, সেটা গত ৩-৪ বছরে কোনও সিনেমা দেখে হয়নি।
ভজ বাজারু রজতাভ দত্ত থেকে শুরু করে গানের মাস্টার হিসাবে অম্বরিশ চক্রবর্তী। সব চরিত্রই একটু, মানে যাকে বলে ‘ওভার-দ্যা-টপ’; এবং সেই ব্যাপারটা সিনেমা থেকে বাদ পড়েনি। ভজবাবু আর গোকুল মাস্টারের (মনোজ মিত্র) দৃশ্যটি সিনেমার সেরা দৃশ্য বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। পরিচালক একবারও গল্পটাকে বাস্তবধর্মী করতে চাননি, এবং সেটাই এই ছবির সবচেয়ে বড় সম্পদ।
শিলাজিতের অভিনয় এবং ছবির গানগুলো একটা বড় প্রশংসার জায়গা, সে যে গানই হোক, ‘মালা-খাঁড়া-হাঁড়িকাঠ, নাহি কোনও শর্টকাট’ থেকে ‘একটা কাক, খতরনাক…’।
ভালো লাগল কতগুলো প্রচ্ছন্ন খোঁচা; কীর্তনের দল ডাকাতদের হাতে ধরা পড়ে বলছে ‘গলতি হো গিয়া সরদার’, আর শিলাজিতের মুখে উত্তর পাচ্ছে ‘বাঙালির বাচ্চা, হিন্দি বলচিস কেনে?’ এবং রাজার ঘরের বাতিল হওয়া নোটকে ‘ডিমনিটাইজেশন’ বলে আখ্যা দেওয়া।
কাতুকুতু দিয়ে লোক হাসানো খুব সোজা, কিন্তু ‘ম-অ-বা’ সেই পথে হাঁটেনি, ফলস্বরূপ শোনা গেছে কিছু ‘উইটি’, মজার ডায়ালগ।
মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি প্রথম প্রকাশিত হয় আনন্দমেলাতে, আর সেখানে সমস্ত ছবি এঁকেছিলেন সুধীর মৈত্র। আসল সেইসব ছবি ব্যবহার করে তৈরী টাইটেল কার্ড অনবদ্য, ছোটবেলার সেই নস্টালজিয়াকে চোখের সামনে সামান্য অ্যানিমেশনে নড়তে চড়তে দেখে ’৯০ দশকের সন্তানদের অন্তত গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে…
যদি সিনেমার ব্যাকরণ মিলিয়ে দেখতে যাই, তাহলে হয়তো বলতে বাধ্য হব, যে ‘এক যে ছিল রাজা’, ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’-এর থেকে অনেক বেশী সিনেমা; কিন্তু ‘এক যে ছিল রাজা’-এর থেকে ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ অনেক বেশী গল্প। অনেক বেশী স্মৃতি।
আমাকে যদি কেউ পর পর সাজাতে বলে, তাহলে আমি মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি কে সবার আগে রাখব, আর তারপর এক যে ছিল রাজা, আর সবার শেষে কিশোর কুমার জুনিয়র। কারণ শেষের দুটো সিনেমার দোষ এক, খুব ভালো অভিনয়টা চিত্রনাট্যের জন্য মার খেয়েছে। কিন্তু কিশোর কুমার জুনিয়র, মারটা একটু বেশীই খেয়েছে…
শান্তির আশায়,
নীল
পুনশ্চ – আমি কোনো সিনেমা বোদ্ধা নই, যা মনে হল, লিখে ফেললুম। কারোর কোনো বক্তব্য (পড়ুন গালী) থাকলে কমেন্ট করুন, মেইল করুন, মোবাইল নম্বর থাকলে হোয়াটস্যাপ বা ফোন করুন…
Like!! Thank you for publishing this awesome article.
LikeLike