শুধু ইনফিনিটি ওয়ার কেন, সেরকম ভাবে দেখলে তখন অ্যাভেঞ্জারস থেকে জাস্টিস লীগ, রূপোলী পর্দায় এদের কারোরই আবির্ভাব ঘটেনি। তখন কেবিল টিভি ছিল লাক্সারী; ছাদের ত্রীভঙ্গমুরারী অ্যান্টেনার কল্যাণে, বাড়িতে চ্যানেল আসত দু’টি; ডিডি ন্যাশানাল, আর ডিডি মেট্রো। আর এই ন্যাশানাল চ্যানেলেই মাঝে মাঝে ন্যাশানাল কোলকাতা নাম দিয়ে বাংলা কিছু প্রোগ্রাম হত।
তা টিভির কথা এতো তোলার একটা কারণ আছে। বাড়ির কনিষ্ঠতম সদস্য হিসাবে; টিভি দেখার অনুমতি আমার একেবারেই ছিল না। শুধু রবিবার আধঘন্টা। আধঘন্টা কেন? কারণ মেট্রো চ্যানেলে রবিবার একটা কার্টুন হত। যেটার নাম ছিল ‘দানাসুর’। জুরাসিক পার্ক দেখা ইস্তক, ডাইনোসরের মোহে যে আমি কিরকম বুঁদ ছিলাম, সেটা আমার বাড়ির লোকেরা খুব ভালো করেই জানে। এমনকি আমাদের রাঁধুনি রবিদা, সে অবধি ‘ডাইনোসিরাপ’ চিনত। তা এই দানাসুর কার্টুনটির বিষয়বস্তু ছিল, কতগুলি বাচ্চা ছেলেমেয়ে একটা জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে একটা ডাইনোসরের ডিম কুড়িয়ে পায়, আর সেই ডিম ফুটে একটি ব্রন্টোসরাস বের হয়, যা পড়ে তাদের বহু অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গী হয়।
তা সেই যুগে, স্মার্টফোন আর ইন্টারনেটের অভাবে, আমার মত ছেলেমেয়েদের একমাত্র হাতিয়ার ছিল, কল্পনা। সেই সময় বাড়িতে মা, বাবা, আর দিদির কাছে আমার একটাই দাবী ছিল;
“গল্প বল।”
নাহলে,
“গল্পবই পড়ে শোনাও।”
তা এ হেন আমি, রোজ রোজই ভাবতাম, ‘আহারে, যদি আমিও দানুর সাথে অ্যাডভেঞ্চারে যেতে পারতাম…’
কিন্তু একা কি করে যাব? ওখানের ছেলেমেয়েগুলো তো বন্ধুরা মিলে যেত, তাহলে?
আমি জানি সবাই হাঁই মাই করে বলে উঠবেন, ‘তোর কোথা থেকে বন্ধু আসবে’ বা ‘তোর তো কোনো বন্ধুই নেই’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
হ্যাঁ, মেনে নিলাম প্রত্যাশা পূরণের দাবী রাখতে অপারগ বলে, আমার একটিও বন্ধুও আর টিকে নেই। কিন্তু আমি যখনকার কথা বলছি, তখন একজন বন্ধুর আর এক বন্ধুর কাছে প্রত্যাশা বলতে ছিল টিফিনের লুচির ভাগ পাওয়া। আর সারাদিন মারামারি চুলোচুলি করে ছুটির সময় ভাব করে নিয়ে বাড়ি ফেরাই ছিল বন্ধুত্ব। কে আর জন্য কত কেজি উপকার করল, আর কে কার কাছে কত কৃতজ্ঞ থাকল, এসব কেউ ভাবত না।
তা এই সহজ সরল বন্ধুত্বের বাজারে, আমারও একটি খুব ভাল বন্ধু ছিল। তার পোশাকি নাম ছিল শ্বেতকেতু, আর আমি ডাকতাম শ্বেত। তাই, আমি ভাবলাম, যদি অ্যাডভেঞ্চারে যাওয়ারই হয়, তাহলে একা যাব কেন? শ্বেতকেও সঙ্গে নিয়ে যাব। আমি জয়ন্ত হলে, ও হবে মাণিক, আমি হোমস তো ও ওয়াটসন। আর আমি গুপী তো ও বাঘা…

তাই আমার অদম্য কল্পনার কেরামতিতে, দানুর অ্যাডভেঞ্চার অচিরেই হয়ে উঠল নীল-শ্বেতের অ্যাডভেঞ্চার। মনে মনে আগডুম বাগডুম যে কত কি যে ভাবতাম, এখন মনেও পড়ে না।
লালমোহনবাবু একটা গল্পে ফেলুদাকে বলেছিলেন, “জলের তল পাওয়া যায়, কিন্তু মনের তল পাওয়া দায়।”
এটা শুধু ফেলুদা কেন, যে যে নিজের কল্পনার ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে দিয়েছে, তাদের সবার ক্ষেত্রেই কথাটা প্রযোজ্য। আমিও তাই সে ব্যাপারে কার্পন্য করিনি। ভাবতে থাকলাম, আচ্ছা, আমাদের সাথে যদি কাকাবাবু আর সন্তু থাকে, তাহলে কেমন হয়? মন বলে উঠল, চমৎকার হয়। একে একে আমার সঙ্গী বাড়তে থাকল। এক এক করে টিনটিন, ফেলুদা, প্রফেসার শঙ্কু, পটলডাঙ্গার চারমূর্তী- কাউকে বাদ দিলাম না। কিন্তু সমস্যা হল, এই এতজন মিলে নীল-শ্বেতের সাঙ্গোপাঙ্গর সংখ্যা যা দাঁড়ালো, তাদের নিয়ে গল্প ফাঁদা, আমার কল্পনার পক্ষেও ওভারডোজ হয়ে গেল। তাই সিধে গিয়ে হাজির হলাম বাবার কাছে;
-“বুয়া, দানুর গল্প বল…”
-“দানুর কোন গল্পটা?”
-“সেই যে, যেটাতে আমি আর শ্বেত দু’জনে আফ্রিকা গেলাম…”
-“সে কি! তুমি আর শ্বেত আবার কবে আফ্রিকা গেলে?”
-“আহা গেলাম তো… কাকাবাবু আর সন্তু যেবার মাসাইমারা গেল…”
-“সর্বনাশ! কাকাবাবুও আছে সে গল্পে?”
আমি বেশ বিরক্ত হয়েই বললাম,
-“কি আশ্চর্য্য! থাকবে না তো যাবে কোথায়? আমি আর শ্বেত যখন অ্যাডভেঞ্চারে যাই, আমরা কখনো কাকাবাবু, ফেলুদা, প্রফেসার শঙ্কু ছাড়া যাই?”
বাবা বুঝতে পারলেন, ব্যাপারটা একটা ভয়ঙ্কর জগাখিচুড়ির আকার নিচ্ছে। তাই আর প্রশ্ন না করে বললেন,
-“আচ্ছা। বলত, কি গল্প; শুনি…”
সেই শুরু হল। আর রোজ স্কুল থেকে ফিরে ছাদে মাদুর পেতে শুয়ে বাপ ছেলেতে ‘দানুর গল্প’ হত। একের পর এক বিকেল কেটে যেত গল্প বলে, শুনে, বানিয়ে। বাবা এক লাইন বললেন, সেটা আমার পচ্ছন্দ না হলে আমি ‘কারেকশান’ করে দিলাম। আর পচ্ছন্দ হলে গল্প এগোতে থাকল। আবার আমি এক লাইন বললাম, বাবা সেটা এগোলেন… এভাবেই…
আসলে কল্পনার জগতে তো আর মুভি রাইটস কেনার দরকার থাকে না, ভাবতে হয় না, ফেলুদার গল্পে টেনিদা কি করবে। প্লট পয়েন্ট কি হল , গল্পে কোথায় ভুল হল, এসব ভাবারও দরকার হয় না। শুধু গল্পের জন্যই গল্প বলা।
একটু বড় হয়ে গল্পগুলো লেখারও চেষ্টা করেছিলাম। কাঁচা কাঁচা হাতের গোটা গোটা লেখায় মায়ের তৈরী করা একটা খাতায় লিখতে শুরু করেছিলাম,
-“একটা জঙ্গলে একটা ডীম ছিল…”
ইনফিনিটি ওয়ারে আগে…
অ্যাভেঞ্জারস-এর আগে…
বড় হয়ে যাওয়ার অনেক, অনেক আগে…
শান্তির আশায়,
নীল…
পুনশ্চ – এখনই জানতে পারলাম, ‘দানাসুর’-এর থীম সং টি গুলজারের লেখা, আর বিশাল ভরদ্বাজের সুর দেওয়া… নীচে ইউটিউব লিংক রইল।
সহজ আর সাবলীল লেখা ।
বেশ তরতরিয়ে পড়া গেল ।
ডাইনোসিরাপ খুব মিষ্টি নাম । ডাইনোসরদের এটা মিষ্টি নামে তো কেউ ডাকে না ।
ভারী অবাক হলাম লেখকের দূরদৃষ্টি দেখে ….কত্ত বছর আগে থেকেই জানতেন যে নীল সাদা জুটি hit হবেই ।
LikeLiked by 1 person