ফুটবল জিনিসটা বাঙালি উত্তরাধিকার সুত্রে পায়, মা বাবার কাছ থেকে, আর আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। আমার মা ফুটবলের পোকা নন, আর তাই আমার ফুটবলের হাতেখড়ি হয়েছে বাবার কাছে। আর বাবা আমকে ছোটবেলায় একটা কথাই বার বার বলতেন।
-“ফুটবল খেলে তো ব্রাজিল, আর কারোর দ্বারা হয় নাকি ?”
অবোধ শিশু তখন আমি, বাবার কথাই ধ্রুবসত্য মনে করতাম… (অনেক ক্ষেত্রে আজও করি)। প্রথম ফুটবল ওয়ার্ল্ড কাপ-এর খবর রাখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার ২০০২ সালে। হ্যাঁ, খবর রাখার, কারণ বাড়িতে কেবল কানেকশন না থাকার দরুন খেলা একটাও দেখতে পারিনি।
খুব আনন্দ হয়েছিল, ব্রাজিল জেতার পর। রোনাল্ডো গোল্ডেন বুট আর অলিভার কান পেলেন গোল্ডেন বল। সেটাতে আবার আমি মনোক্ষুণ্ণ হয়েছিলাম। গোল্ডেন বলটাই বা ব্রাজিল পাবে না কেন?
ক্লাস সিক্সের সেই বাচ্চা ছেলেটা পরের ওয়ার্ল্ড কাপের আগে মাধ্যমিকের দোরগোড়ায় পৌছে গেল। সেবার বাড়িতে কেবল ছিল, ঠাকুমার ঘরে। আর রাতের আগে সে টিভিতে হাত পড়ার কোনো উপায় ছিল না। রাতে জাগার স্বভাব আমার কোনোদিনই ছিল না, তাই রাতের দিকে খেলা দেখতামও না। অদ্ভূতভাবে, যেদিন প্রথম খেলা দেখতে পারি আমি, সেদিন খেলাটা ছিল কোয়ার্টার ফাইনাল। আর্জেন্টিনা বনাম জার্মানি। জার্মানি তখন ১-০ তে হারছে। দিদি ফোনে জামাইবাবুর সাথে ঝগড়া করছে;
-“এবার তোর টিম সেমিফাইনালেও যাবে না…”

বলে রাখা ভাল, আমার দিদি বাতিস্তুতার যুগ থেকে আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। জামাইবাবু, মানে কৌস্তভদা যে জার্মানির সাপোর্টার, সেটা জানতাম। সেদিন নেহাত দিদির সাথে ঝগড়া করব, এই ভেবেই, মনে মনে জার্মানিকে সাপোর্ট করতে করতে খেলাটা দেখতে বসে গেলাম।
সবাই জানেন, মাইকেল ব্যালাক-এর পাস প্রথমে বোরোস্কি হেড দিয়ে, তারপর ক্লোসের হেডে গোল শোধ করার পর, টাইব্রেকারে ৪-২ তে জেতে জার্মানি।
খেলাটা যখন শেষ হয়, তখন আমার জার্মানির ফ্যান হওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না… সেদিন বুঝেছিলাম, টিমগেম কাকে বলে, শেষ মুহুর্ত অবধি দাঁতে দাঁতে চেপে লড়ে যাওয়া কাকে বলে। লোকে যদি ব্রাজিলের স্কিলের প্রেমে পাগল হতে পারে, তাহলে জার্মানির ‘স্প্রিরিটের’ ভক্ত হয়ে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব নয়।
হ্যাঁ, এখন হয়তো ব্রাজিলের কট্টর ভক্তরা আমাকে গালাগাল করতে পারে ‘গদ্দার’ বলে। কিন্তু, কিছু করার নেই। মানুন বা না মানুন, ব্রাজিলের সেই স্কিল বেসড ফুটবল, আর পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন, এক জিনিস। কথায় আছে, কাজে নেই…
তাই ২০০৮ এর পর থেকে, জার্মানি ছাড়া আর কোনো দলকে সমর্থনের কথা ভাবতে পারিনি। আর ২০০৬ থেকে ১০১৪ অবধি অপেক্ষা করার পর জার্মানি ওয়ার্ল্ড কাপ পেল… ২০১৬-এর ইউরোও পেল না। ক্লোসে, লাম, পোডোলস্কি… এমনকি সোয়াইন্সটেইগারও অবসর নিলেন, কিন্তু জার্মানির ফুটবলের সত্ত্বাটা অটুট রয়ে গেল।
ইউরগেন ক্লীন্সম্যান থেকে জোয়াকিম লো; কোচ বদল হল, কিন্তু ফুটবলটা এক থাকল। শুধু সেই ফুটবলের টানে টানেই, আজও ওই একদলের খেলার জন্যই বিশ্বকাপের উৎসাহটা আছে, আমার অন্তত। বিশ্বকাপ পেলে ভাল, না পেলে বেটার লাক নেক্সট টাইম…
তাই সব টিমের সাপোর্টারদের বেস্ট অফ লাক; যারা জার্মানির সাপোর্টার নন, তারা প্রার্থনা করুন, যাতে জার্মানির সামনে না পড়তে হয়…
শান্তির আশার…
নীল…
পুনশ্চ – আজ খেলার রেজাল্ট যাই হোক নে কেন, জার্মানি থেকে সাবধান…