কলকাতার ভাগাড়-বিলাস…

প্রথমেই, গত দু’সপ্তাহের অনুপস্থিতির জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি! কারণ যাইহোক, সেগুলো খতিয়ে দেখলে শেষমেশ সেই চিরাচরিত ল্যাদের ক্যাটেগরীতেই পড়বে; তাই সে গভীরে না গিয়ে সিধে কাজের কথায় আসি। যদিও সেভাবে ভেবে দেখতে গেলে, আমি কাজের কথা খুব একটা বলি না, কিন্তু যাকগে যাক। আজ বড্ড বেশী বিশ্লেষণ করে ফেলছি…

এ সপ্তাহটা কলকাতাবাসীর বড্ড বাজে গেল… মানে অনেক দিক থেকেই। বহুদিন পরে, আজ আবার সর্বভূক বাঙালীর পেটে টান পড়েছে! কারণ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের ‘ভাঙন ধরানো খবর’ অনুযায়ী, আপনি নাকি গত পনেরো বছর ধরে রামপাখির নামে যুধিষ্ঠীরের বাহন ভক্ষণ করেছেন। শুধু তাই নয়, পচা মাংসও গেছে আপনার পেটে। তাই ক্ষুধাতুর বাঙালি আজ পেটে কিল মেরে নিরামিষ গিলছে, কেউ ভয়ে, কেউ বা স্রেফ ঘেন্নায়। আর সোশ্যাল মিডিয়া তো তার সার্কাস দেখাতে মাঠে নেমেছে সবার আগে…

-“অমুক অমুক রেস্তরাঁতে পচা মাংস সাপ্লাই হত…” – এই বলে এক বিঘত লম্বা একটা লিস্টি বেরিয়ে পড়ল ফেসবুক-এ, হোয়াটস্যাপ-এ। আরে বাবা, ভালো করে দেখ, একগাদা আমিষের মাঝখানে একটা নিরামিষ রেস্তরাঁর নাম আছে যে!

কিন্তু না! হুজুগে বাঙালি মেতে পড়ল… কারন তারা জানে, ‘শেয়ারিং, ইজ কেয়ারিং…”

কত রেস্তরাঁ তো বলেই দিল

-“আমাদের নামে মিথ্যে অপবাদ দিলে, পুলিসে দেব…”

এই চাপান-উতোর পর্বে আবার লোকে কবি হয়ে উঠল…

“খেয়ে পাঁঠার ঝোল, তুলিলাম ঢেঁকুর…

পেট থেকে পাঁঠা বলে, ‘দাদা, আমি কুকুর!’ ”

হাজার বিপদের মধ্যেও সেন্স অফ হিউমার জ্যান্ত রাখা, একমাত্র বাঙালির পক্ষেই সম্ভব। এরকম ‘হাইকু’-এর জন্য রচয়িতা কে তাই সাধুবাদ না দিয়ে পারি না…

 

CIpc-LWUAAAwu5M
😀

 

মাংস-বিভীষিকা কাটতে না কাটতেই হল আর এক সমস্যা। দমদম মেট্রোয় আলিঙ্গঙ্কারী এক ‘কাপুল’কে দমাদম মার লাগানো হল। আর সেটা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যা হল, সেটা পড়ে হাসব, না কাঁদব ভেবে পেলাম না। প্রথমে প্রতিবাদ এর ঝড়, তারপর কিছু লোকজন বলল ‘পিটিয়েছে বেশ করেছে’। কিছু লোকজন বলল, ‘মেট্রোর মধ্যে যৌনতা? শেম শেম’ তারপর লোকে গপ্প লিখে, ভিডিও বানিয়ে, তারপর সে ভিডিও ডিলিট করে একক্কার কান্ড করল। চোখের আন্দাজে অনেক লোককে শনাক্ত করে নির্দোষ লোকেদের হেনস্থাও করা হল। অনেক মিম তৈরী হল, অনেক জল ঘোলা হল, শেষমেশ দেখা গেল, ভিক্টিম-ভিলেন সবাই বেপাত্তা।

এবার, এখানে আমার মতামত কি, সেটাই বলি।

দেখুন মশাই, কলকাতা আমার মতে প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য সবথেকে নিরাপদ শহর; খাপ পঞ্চায়েত নেই, অনার কিলিং নেই(ব্যাতিক্রম প্রিয়াংকা-রিজওয়ানুর), রাস্তাঘাটে যুগলদের একটাই সমস্যা, সেটা হল হিজড়েদের উৎপাত। এখন সেদিন মেট্রোয় কি হয়েছিল, কেন হয়েছিল, কারো শোনা কথায় কোনো সিদ্ধান্তে এসে আমি কথা বলতে চাই না, আমি শুধু সবদিক থেকে আমার মতামত ব্যক্ত করব।

প্রথমত, কারো গায়ে হাত তোলা, রাস্তায় ঘাটে, সে আমার চেয়ে বয়সে ছোট হোক বা বড়, আমি এক্কেবারেই সমর্থন করি না। এবং, যতদুর জানি, সেটা ভারতীয় সংবিধানে ফৌজদারী অপরাধের মধ্যে পড়ে। যদি মনে হয় পাবলিক প্লেসে কেউ বেলেল্লাপনা করছে, তাকে পুলিসের হাতে তুলে দাও, গনধোলাই দেওয়ার তুমি কে? আলোকনাথ? না রজনীকান্ত?

দ্বিতীয়ত, সংবিধানের কথায় যদি আসি, সংবিধানের আর্টিক্যাল ১৯(১)(এ) বলে, প্রকাশ্যে আলিঙ্গন, এবং চুম্বন, কোনোটাই অপরাধমূলক নয় এবং অশ্লীল নয়, এবং সেকশন ২৯৪ বলে, যে কোনো রকম অশ্লীলতা দন্ডনীয় অপরাধ। এবার জাপটে চুমু খেতে খেতে যদি কেউ অশ্লীল হয়ে যায় (সেটা মেট্রোর মধ্যে কিভাবে সম্ভব, আমার মোটা মাথায় তো ঢোকে না)- তো পুলিসে দিন, ঘাড় ধরে পুলিসে দিন। গায়ে হাত তোলার আপনি কে? বয়সে বড় বলে সমাজ সংস্কারের দায়িত্ব তো কেউ আপনাকে দেয়নি!

এবার আসি জেনারেশন গ্যাপের কথায়। সেদিন ট্রেনে মাঝবয়সী বা বৃদ্ধ লোকগুলির অতৃপ্ত যৌন বাসনা ছিল কিনা, আমি জানি না… সেদিন ছেলে আর মেয়েটি তাদের গালাগালি করেছিল কিনা আমি জানি না… কিন্তু কথা হল, সেদিন থেকে বেশ কিছু ভদ্রলোকের ফেসবুক প্রোফাইলের ছবি বিভিন্ন পেজে ছেড়ে, যেভাবে গালাগালি করা হল, সেটাও সমর্থনযোগ্য নয়, সেটা সাইবার-বুলিং-এর পর্যায় পড়ে।

আর সবচেয়ে বড় কথা হল… বয়স তুলে গালাগালি দেওয়া, এর চেয়ে হাসির আর কিছু হতে পারে না। কারণ, বয়েস কারোর থেমে থাকে না। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর, যদি আমার প্রোফাইলে লোকে হাজার হাজার খিস্তি করে, আমি নিতে পারব? মানসিক চাপটা ?

এবার বলি, বয়স-জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে, মানুষ মাত্রই ছাঁচড়া। ভরদুপুরে ইলিয়ট পার্ক, সেন্ট্রাল পার্ক, এর ভেতর এক চক্কর হেঁটে আসবেন। দেখবেন ঝোপে ঝাড়ে কামসূত্রের নতুন চ্যাপ্টার লেখা চলছে। আর আজই তো, আমি কলেজ থেকে ফেরার পথে দেখলাম এক দাদু, বড়রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে তলপেটের ওপর লুঙ্গি তুলে মুত্র বিসর্জন করছেন। একবার ভেবে বলুন তো, এদের মধ্যে কোনটা বেশি অশ্লীল?

ভাবুন, ভাবুন… এ প্রশ্নের উত্তরের ওপর বাঙালির ভবিষ্যত নির্ভরশীল। এর উত্তরই স্থির করবে, বাঙালির তথা কলকাতার ‘মানসিকতার’ ভাগাড়-বিলাস, আর কতদিন চলবে…

 

শান্তির আশায়,

নীল…

2 thoughts on “কলকাতার ভাগাড়-বিলাস…

Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.