বিয়েবাড়ির গপ্পো…

আজ একটু অন্যরকমের পোষ্ট। অন্যরকমের ঠিক নয়, আসলে এটা অনেকটা পুজো স্পেশ্যাল পোস্টটার মতই; আর একটা স্মৃতিচারণ। আসলে বিয়েবাড়ি অ্যাটেন্ড করা আর নিজের বাড়ির বিয়েতে অংশগ্রহন করা, দুটো জিনিসের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত। কিন্তু, সেটা সবারই জানা। তাহলে, নতুন কি গপ্পো শোনানোর জন্য আজ কলম থুড়ি কিবোর্ড ধরলাম?

গল্পটা আসলে অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা বিয়েবাড়ির গল্প।

আমার কাকার বিয়ে হয় ১৯৯৮ সালে। আমার তখন বয়স ৬, আর আমার বোন (পিসতুতো, মানে ছোট পিসির কনিষ্ঠা কন্যা), তার বয়স হল ৪। আমরা বাড়ির কনিষ্ঠতম সদস্য; আর একটা বিয়েবাড়ির শোরগোলে আমরা কি করলাম, সেদিকে বড়রা সজাগ দৃষ্টি রাখার চেষ্টা করলেও, আমরা আমাদের আকৃতির জন্য লোকের পায়ের আর বগলের তলা (লিটারালি এবং মেটাফোরিকালি) গলে পালাতে এক্সপার্ট ছিলাম। কিন্তু সেসব ঘটনায় ঢোকার আগে, আমাদের বাড়ির বিয়ের স্ট্রাকচারটা বোঝানো বিশেষ দরকার।

12938141_475156156011717_670845820590460604_n
তখন…
14570374_10210573125822359_6633032307989113535_n
এখন…

কবে আমাদের কোন এক পূর্বপুরুষ রাজস্থানে বাস করার সুবাদে, আমরা রাজপুত, কিন্তু অন্যদিকে আমরা বাঙ্গালীও বটে। এই দুই কালচারের সঙ্গমে দাঁড়িয়ে থাকার দরুন আমাদের বিয়ের নিয়মকানুন সাধারণ বাঙালী বিয়ের থেকে অনেকটাই আলাদা। এবং আগে লোকের হাতে সময় প্রচুর ছিল বলে আমার কাকার বিয়েটি যতটা পারা যায় নিয়ম মেনে করা হয়, এবং সাতদিন সময় লাগে। তখনকার সস্তাগন্ডার বাজারে সাতদিন বিয়েবাড়ি ভাড়া নেওয়া সম্ভব ছিল, এখন আর নয়। তাই সাতদিন ধরে বাড়ি গম গম করছে, খাওয়া দাওয়া, আড্ডা, হৈ চৈ, সবমিলিয়ে এখন ভাবলে দিনগুলো স্বপ্নের মতো মনে হয়। এখন ব্যাপার হল, তখন আমার দিদি উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছে, দাদারা কলেজগামী, মামাতো ভাইরা কেউ ন্যাপি পরিহিত, কারোর আবার অস্তিত্যই নেই তখন। তাই আমাদের দুই পুঁচকে তখন একে অপরের সাহারা। কারণ বড়রা শাসন করছেন আমাদের, নিজেরা করছেন হৈ-হুল্লোড়। দাদা দিদিরা বুঝে গেছে এই দুইখানি ধানিলংকার দায়িত্ব নিলে নিজেদের মজা মাটি, সুতরাং ‘কিপ সেফ ডিসটেন্স’। আমার দিদি সেসময় সবচেয়ে বেশী উৎসাহ পেত আমাদের দুপুরে ঘুম পাড়াতে। কারণ খোকা-খুকি ঘুমালে, পাড়া না হোক, বাড়ি সত্যিই জুড়াতো।

কারণ, কিই না করিনি আমরা সেসময়? সবাই মিলে মাঠে হাওয়া খেতে যাওয়া হয়েছিল। সবুজ ঘাস দেখে আমাদের ভারী আহ্লাদ হয়, আমরা ঘাসে গড়াগড়ি দিতে শুরু করি, দিদি আমাদের কান ধরে তোলার আগে অবধি। সারা বাড়িতে শোরগোল, আমার শান্তিপ্রিয় বোন তাই একখানা বালিস জোগাড় করে বাড়ির বাইরের রকে শুয়ে সুখনিদ্রা দেওয়ার চেষ্টা করে, কুকুরদের পাশে। সত্যি কথা বলতে কি, কুড়ি বছর আগের কথা তো, আর নিজের কুকীর্তির কথা মানুষের মনেও থাকে না। তার মধ্যে আমাদের ঝগড়াও হত, ভাবও হয়ে যেত ক্ষণে ক্ষণে।

বিয়ের অনেক নিয়ম-কানুনের মধ্যে দু’টো আমার খুব ভালো করে মনে আছে; এক হল কুমার ভোজন। সেটা হল বিয়ে আগের দিন বরকে দেখিয়ে দেখিয়ে বাড়ির অবিবাহত ছেলে-মেয়েরা ভালোমন্দ খাবে, আর বর খালি পাতে মুখ হাঁড়ি করে বসে যাবে। কাকার পাশে বসেছিলাম আমি, আর কাকাকে দেখিয়ে দেখিয়ে রসোগোল্লা খেতে গিয়ে বিষম লেগে সে একাক্কার কান্ড। কাকাই অবশেষে আমার পিঠ চাপড়ে জল খাইয়ে ধাতস্থ করে।

IMG_20180224_0001
রঙ খেলা…

দু নম্বর জিনিস যেটা আমার অত্যন্ত পচ্ছন্দের, সেটা হল রঙ খেলা। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন, রঙ খেলা। বিয়ের দু’দিন আগে দোলের অকালবোধন। বাড়ির সবাই মিলে ছাদে রঙের ফোয়ারা ছোটানো। কিন্তু এখানেও আমি আর বোন পড়লাম বিপদে। কারণ রঙ মাখাবো কাকে? লোকের মুখের নাগালেই তো আমাদের হাত পৌছোয় না। আমি বোন কে দু-একবার রং মাখানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু খুকি তখন এতই ছিঁচকাঁদুনে ছিলেন; ভ্যাঁ করে দিলেন কেঁদে। ভয়ে আমি আর কাউকে রঙ মাখানোর চেষ্টা করিনি, শুধু ঘুরে ঘুরে দেখলাম সবাই কত মজা করল। তখন তো বুঝতে পারিনি, এখন বুঝি, সেইদিন বাড়ির সবাই ছাদে কি পরিমাণ মজা করেছিল। এমনকি রঙ মাখা শেষ হয়ে যাওয়ার পর ছাদে ঢোল বাজিয়ে নাচ গান, কিছুই বাদ ছিল না।

IMG_20180224_0001 (3)
বর ও নিতবর…

অবশেষে বিয়ের দিন এল। এবার কথা হল আমাদের বিয়েতে বরের চেয়ে বোধহয় নিতবরের গুরুত্ব বেশী; আর বয়সটা কম বলে সবার ষড়যন্ত্রে, আমিই নিতবরের ভূমিকায় শহিদ হয়ে গেলাম। তখন তো খুব উৎসাহের সঙ্গেই নিতবর হয়েছিলাম, পাগড়ী-শেরওয়ানি পরার লোভে। আর আজ, মানে কাকার পর আমার তিন দাদার বিয়ে মিলিয়ে টোটাল চারবার শহিদ হয়েছি আমি। আর মাইরি বলছি, কাকার পর সেজদার বিয়ে অবধি ঠিক ছিল (তখন ক্লাস সিক্স), তারপর মেজদার বিয়েতে (ক্লাস ইলেভেন) পাত্রীপক্ষ একটা একস্ট্রা টোপর জোগাড় করে আমার সাথে একটা বিচ্ছিরি রসিকাতার চেষ্টা করেছিল। আর ছোড়দার বিয়েতে (কলেজের সেকেন্ড ইয়ার) তো লোকজন আমাকেই বর ঠাওরেছিল। যাক গে যাক; কাকার বিয়েতে ফিরি আপাতত। কাকার সাথে নিতবর সেজে ফুলে সাজানো গাড়িতে বিয়েবাড়ি পৌছোলাম। মনে খুব ফূর্তি! জীবনে প্রথমবার রাত জাগা হবে। কিন্তু, হা হতোস্মি! বরের পাশে বসে দিব্যি ভিডিও ক্যামেরার বিরক্তিকর আলো থেকে নিজের চোখ বাঁচাচ্ছি, কোথা থেকে বাবার আগমন।

-“গদাই! সাড়ে ছটা বেজে গেছে, বাড়ি চল, ঘুমোনোর সময় হয়ে গেছে…”

চোখের জলে নাকের জলে ভাসতে ভাসতে ফিরে এলাম বাড়ি। ভাবলাম সবাই রাত জাগবে, আনন্দ করবে, কেবল আমিই…

কিন্তু বাড়ি পৌছে দেখি, না! একা আমি না, আমার মতো চোখের জলে নাকের জলে ভেসে বোনও বাড়িতে ঘুমের তোড়জোড় করছে। আর আমায় পায় কে! হাজার হোক, একটা সঙ্গী তো পাওয়া গেল! তাই ভাই বোনে গলা জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে পড়লুম।

রাত জাগার সৌভাগ্য আমাদের হয়, প্রীতিভোজের দিন। সেদিন বাড়ীর সবাই ব্যস্ত, তাই আমাদের ঘুম পাড়ানোর কথা আর কারোর মনে থাকে না। তার মধ্যেও নাকি আমার মা আমাকে খুঁজে না পেয়ে আবিস্কার করেন বিয়েবাড়ির সামনের কৃত্রিম ফোয়ারায় আমি স্নান করছি।

যা বললাম, আজ থেকে কুড়ি বছর আগেকার ঘটনা; শুধু এই বিয়ের না, যেকোনো বিয়ের একটা অদ্ভূত বৈশিষ্ট্য হল, একটা বিয়ের উপলক্ষ হল বর আর বউ। কিন্তু গোটা বিয়ে অনুষ্ঠানের সমস্ত স্মৃতি, হাসি ঠাট্টা, সব কিছু কিন্তু তৈরী করে তাদের কাছের মানুষেরা। কারণ বিয়েটা হয় সবার জন্য, বিবাহিত জীবনটা ব্যক্তিগত। সবাই, ‘বিবাহিত জীবন সুখের হোক’ এই কামনা করে; কারণ অনেক অনেক আনন্দের এই যে স্মৃতিগুলোতে কেমন কালো দাগ পড়ে যায়, সেই ব্যক্তিগত জীবনটা সুখের না হলে। তাই সেই গভীরতায় না গিয়ে আজ ওপর ওপরই দেখি জিনিসগুলো; কারণ সুখ দুঃখ কোনোটাই তো আর চিরস্থায়ী নয়…

শান্তির আশায়,

নীল

Advertisement

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.