চার দিন পর পর বইমেলা গিয়ে তারপর সেটার সমালোচনা করা মানে হল গিয়ে নিজের পায়ে কুড়ুল মারা। কারণ, অচিরেই লোকে গালি দেবে। কিন্তু সপ্তাহের পর সপ্তাহ গালি খাওয়া অভ্যেস হয়ে গেছে বলে, এবারো কিছু গায়ে লাগবে না জানি, তাই লিখতেই বসলাম।
কিন্তু এ লেখাটা আমার মতে ঠিক সমালোচনা নয়, যদিও সেটা পাঠকেরাই বিচার করবেন। আমার মতে এটা একটা তুলনামুলক আলোচনা। কারণ ছোটোবেলায় বাবার হাত ধরে ময়দান থেকে শুরু করে; কলেজ কেটে মিলন মেলার পর, এবার সেন্ট্রাল পার্কের কথা ধরলে, বইমেলার সঙ্গে এই আত্মিক সম্পর্কটা আমার আজন্ম বললেও ভুল বলা হবে না। তো সেই বই এবং বইমেলার কতগুলো আমূল পরিবর্তন দেখে, মনে হল কিছু বলা দরকার, তাই এই পোষ্টের অবতারণা।
আগে বইমেলায় ঢুকতে টিকিট কাটতে হত। এখন ফ্রি, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে টিকিট কাটার প্রথাটা ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরী; গালি দেওয়ার আগে ভেবে দেখুন, বইমেলায় আগেও ভীড় হত, এখনো হয়, কিন্তু ফ্রী বলে, প্রচুর লোক ঢোকে, যাদের কাজ হল এলাম, খেলাম, সেলফী নিলাম, কেটে পড়লাম। পুরো জুলিয়াস সীজার! ভিনি, ভিডি, সেলফী… এনাদের বইতে বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই, শুধু ‘হ্যাভিং ফান অ্যাট বইমেলা’ স্ট্যাটাস দিতে বইমেলা আসা। খেতে হয় তো খাদ্যমেলায় যা না বাপ! এই তো পরশুদিন, পেঙ্গুইন এর স্টলে এক কপোত-কপোতির সাথে দেখা; দুজনের কথাবার্তা ছিল অনেকটা এরকম;
কপোত – কি রে, কোনো বই কিনবি নাকি ?
কপোতি – না রে, দেখছি, কোনোটারই ‘কভার’ পচ্ছন্দ হচ্ছে না।
আমি – ……………
পাগল ভাল কর মা !
শুনেছিলাম কথায় বলে ‘ডু নট জাজ অ্যা বুক বাই ইটস কভার’; কিন্তু এনাদের কথা শুনে আমার বলতে ইচ্ছে হল অনেকটা জলি এল এল বি এর আরশাদ ওয়ার্শি-এর মতন
-“কৌন হায় ইয়ে লোগ? কাহাঁসে আতে হ্যায় ?”
যাই হোক; আমি লিখে দিতে পারি, এরকম বহু কপোত কপোতি বইমেলার তাকে তাকে হেগে বেড়াচ্ছেন…
তা ছাড়া কোন এক বিশেষ লেখিকা কি করে ফি-বছর ১০-২০ টা করে বই ছাপাচ্ছেন, (তাও আবার দে’জ পাবলিশিং থেকে,) ভাবলে আমার প্রত্যয় হয় না… থুড়ি পেত্যয় হয় না!
বইমেলা যেভাবে দিন দিন ‘সংস্কৃতি মেলায়’ রূপান্তরিত হচ্ছে, তাতে কোনদিন এটার নাম পালটে ‘কলিকাতা আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি মেলা’ না রেখে দেন হেড অফিসের হেডমিস্ট্রেস… বইমেলার একেবারে কেন্দ্রে ‘জাগো বাংলা’; আবার সেই বইমেলার গেটেও খানকতক বিশ্ববাংলার ‘ব’… মানে যাব কোথায়!

এ তো গেল নেগেটিভ পয়েন্ট, এবার আসি অন্যদিকে। ছোটবেলায় যখন বইয়ের নেশায় পাগল ছিলাম, তখন ফিল্মস্টারদের থেকেও বড় সেলিব্রিটি আমার কাছে ছিলেন লেখক-লেখিকারা; আর তখন এত সোশ্যাল মিডিয়ার রমরমা ছিল না বলে, কখন কোন লেখক কোন স্টলে থাকবেন, জেনে তাঁর সাথে দেখা করা, অত্যন্ত দুস্কর ব্যাপার ছিল। কিন্তু এখন সেটা বেড়েছে, এবং লেখক-পাঠক কথোপকথন অবশেষে সাহিত্যকেই সমৃদ্ধ করছে।
আবার, এর একটা খারাপ দিকও আছে। ধরুন আপনার প্রিয় লেখক/লেখিকার নতুন বইটা ঝুল হয়েছে, আপনি বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়েছেন। এবার সেই প্রকাশনীর স্টলে ঢুকতেই, সেই লেখক/লেখিকা একগাল হেসে আপনার হাতে তার নতুন বইয়ের একটা কপি তুলে দিলেন। কি করে রিফিউস করবেন ? এ একেবারে উভয়সংকট।
বইমেলায় ফ্রি তে ওয়াই-ফাই পাওয়া যাচ্ছে, আনন্দের কথা; কিন্তু একটু বলতে পারবেন, ডাটা গুঁড়ো মশলা, মেদিনীপুর শিল্প প্রতিষ্ঠানের আচার আর কুইক হিল অ্যান্টি ভাইরাস বইমেলায় কি করছে ? তারা কি জগতের আনন্দযজ্ঞে মশলা আর আচারের সাপ্লাই দেবে ? না বইমেলাকে ভাইরাস মুক্ত করবে?
তাই বইমেলা পাল্টেছে, আর সবটা ভালোর দিকে নয়, কারণ কোনো পরিবর্তনই নিখুঁত, সর্বাঙ্গসুন্দর হয় না। অনেকে বলেছেন ময়দান থেকে চলে যাওয়ার পর থেকেই নাকি বইমেলার চার্ম চলে গেছে। সেটা আমি মনে করি না; কারণ বইমেলার আসল চার্ম হল বই, বইয়ের গন্ধ, আর সারাদিন ঘুরে ধুরে একটা একটা স্টল থেকে লুকোনো মণিমাণিক্য সন্ধান করে বের করে আনা। সেটা গড়ের মাঠে হল না ধাপার মাঠে, আমার কাছে যায় আসে না; কারণ আমার ‘লয়্যালিটি’ কেবল বইয়ের কাছে, কাঠের স্টল হল না কংক্রীটের মল, সেটা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপার।
শান্তির আশায়,
নীল
পুনশ্চ – কাল বইমেলায় কার কার সাথে দেখা হচ্ছে ? জানান। কাল না হলে পরশু ? নাহলে তার পরের দিন ? জানান; দেখা হয়ে যাবে কোনো না কোনো সময়…