বিশেষ দ্রষ্টব্য – নীচের লেখাটি শুধুমাত্র লেখকের নিজস্ব মতামত; কারোর মন, ধারণা বা কৈশোরের ফ্যান্টাসিতে আঘাত দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। তাই, গালি দেবেন না, আর যদি একান্তই দিতে চান, সারাহা তে দিন, নিচে লিংক দেওয়া রইল।
আর পাঁচটা স্বপ্নালু কিশোরের মত, আমিও ছোটোবেলা থেকেই গোয়েন্দা গল্পের দারুন ভক্ত। তা জানি না কেন আজ, মানে সেই কৈশোর পেরিয়ে আসার এতদিন পর, মনে হল দেখি না একবার, সেই রক্তমাংসের সুপারহিউম্যানদের, যারা কেবল বুদ্ধির জোরে কত ক্রিমিনালের শক্ত ঘাঁটি ধুলিস্যাত করেছেন, কারণ বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের রূচি বদলের ফলে, কিশোর সাহিত্যে আর মন ভরে না, যতই চেষ্টা করি না কেন। আর তাই অনেক বই-ই মলাটে ধুলোর আস্তরন নিয়ে অন্য এক কিশোরের প্রতিক্ষা করে।
বিদেশী সাহিত্য বাদ দিলেও, বাংলা ভাষায় গন্ডা গন্ডা গোয়েন্দা আছে; কৈশোর ও বয়স্ক সাহিত্য মিলে। ফেলুদা, ব্যোমকেশ, অর্জুন থেকে পি কে বাসু, শবর কাউকেই বাদের খাতায় ফেলা যায় না। আর বেশিরভাগ কিশোরের মতই, আমার গোয়েন্দা গল্প পড়া শুরু হয় ফেলুদা দিয়ে। ছোটবেলায়, মানে কিশোর

বয়সটাই হল ফেলুদা পড়ার আদর্শ সময়, কারণ যত দিন গেছে, মানে আমি শেষবার ফেলুদা পড়েছি গ্র্যাজুয়েশনের ফাইনাল ইয়ারে পড়াকালীন; তখন গল্পগুলো বড্ড প্রেডিক্টেবল লেগেছে, (আমার লেগেছে) তাই ফেলুদা আমার কাছে একটা নস্ট্যালজিয়া, মানে অনেকটা ভিন্টেজ গাড়ির মত, চলে না বললেই চলে, কিন্তু দেখলে বুকটা ভরে ওঠে, শ্রদ্ধা হয়। ফেলুদা তাই কিশোর সাহিত্য হয়েই মনটা ভরে রাখে।
সত্যি বলতে কি, ‘কিশোর সাহিত্য’ কথাটার কোনো তর্জমা হয় না; কারণ জিনিসটি খাঁটি বাঙালি, বিদেশে সেরকম ভাবে আলাদা কোনো ক্যাটাগরি নেই। হ্যাঁ, মানছি এনিড ব্লাইটনের ‘ফেমাস ফাইভ’ কিশোর সাহিত্য ঠিকই, কিন্তু এরকম উদাহরন আছে মুষ্টিমেয়।

অন্যদিকে ব্যোমকেশ আবার ঠিক কিশোর সাহিত্য নয়, কারণ অবৈধ প্রেম, ক্রাইম অফ প্যাশন, সবই উঠে এসেছে ব্যোমকেশের পাতায় পাতায়। কিন্তু এটাই আবার হয়েছে ব্যোমকেশের কাল। কিশোর সাহিত্য নিয়ে যদি সিনেমা হয়, সেখানে সিনেমাটার টারগেট অডিয়েন্স প্রী-টীন বা টীন এজার রাই হয়। সেখানে গল্প হের ফের করে খুব একটা সর্বনাশ করার জায়গা থাকে না (তাতেও যে সর্বনাশ হয় না ভুল কথা, প্রচুর জলজ্যান্ত উদাহরন আছে।)। কিন্তু একটা বয়স্ক সাহিত্য নিয়ে সিনেমা হলে অনেক সময় চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক ‘ক্রিয়েটিভ ফ্রীডম’ জিনিসটার এমনই অপব্যবহার করে থাকেন, যে আমার মত সনাতন বাংলা সাহিত্যপ্রেমী সিনেমা হলে বসে ক্রমাগত হেঁচকি তোলে। তাই ব্যোমকেশ ঠিক লেবুর মত, পাঁচহাতের চটকানি খেয়ে তিক্ততার পথে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে। ২০১০ সালের আগে, ছোটপর্দায় রজিত কাপুর আর অন্য কিছু বাংলা চ্যানেলের প্রয়াস বাদ দিলে, বড়পর্দায় ব্যোমকেশের আবির্ভাব হয়েছিল দু’বার। এক, মঞ্জু দে পরিচালিত পথের কাঁটা; দুই। সত্যজিৎ রায়ের চিড়িয়াখানা।
কিন্তু, কপিরাইট উঠে যাওয়ার জন্যই হোক বা যে কারণেই হোক, ২০১০ এর পর, গুনলে, ব্যোমকেশকে নিয়ে ১৪ খানা সিনেমা হয়েছে! ভাবা যায়!!
যাই হোক, এই সিনেমাতে ব্যোমকেশের ভূমিকায় দেখা গেছে আবীর চট্ট্যোপাধ্যায়, নয়তো যিশু সেনগুপ্তকে। একটি মাত্র সিনেমা, যেটা হিন্দিতে, সেখানে দেখা গেছে সুশান্ত সিং রাজপুত কে আর অন্য একটিতে সুজয় ঘোষ কে। এবার এদের মধ্যে কে ভালো ব্যোমকেশ, সে বিতর্কে যেতে চাই না। শুধু একটা কথা বলতে চাই; ধুতি, মোটা চশমা সহযোগে, কাউকেই ব্যোমকেশ হিসাবে খারাপ মানায় নি (সুজয় ঘোষ ছাড়া, ওনার কথা না বলাই ভালো); আমার সমস্যা হল সত্যবতীকে নিয়ে। শরদিন্দুর বর্ণণা অনুসারে আমার আদর্শ সত্যবতী মনে হয়েছে কেবলমাত্র দিব্যা মেনন কে (ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী! ,২০১২)। (এবার গালি দিতে হলে দিন)
তবে বাংলা ভাষায়, আমার প্রিয় গোয়েন্দা যদি কেউ থেকে থাকেন, তো তিনি হলেন নারায়ণ সান্যালের পি কে বসু। পেরি মেসনের আদলে তৈরী এই ব্যারিস্টার-গোয়েন্দাটি আমার প্রিয় তার দুটি কারণ। ১। এনার গল্পগুলো কিশোর সাহিত্য নয় বলেই এখনো আমার কাছে গ্রিপিং। আর দুই, কাঁটা সিরিজের সব গল্প আমার পড়া নেই। তাই খিদেটা রয়ে গেছে। আমার মনে হয়েছে, গোয়েন্দা হিসাবে তাই প্রসন্নকুমার বাসু নিতান্তই আন্ডাররেটেড। কারণ ব্যোমকেশ আর ফেলুদার কে নিয়ে যেখানে এত জল্পনা কল্পনা, এত সিনেমা, সেখানে পি কে বাসুর রূপোলি পর্দায় আগমন মাত্র একবার, যদি জানতেম (১৯৭৪)। যেখানে নিহাররঞ্জন গুপ্তর ‘কিরিটি রায়’ও রূপোলি পর্দাগামী এমনকি গতকার গোয়েন্দা শবরের তৃতীয় সিনেমা রিলিজ করল। (যারা জানেন না, তাদের জানিয়ে দি, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় যেমন বড়দের জন্য শবর লিখেছেন, তেমনি কিশোরদের জন্য লিখেছেন গোয়েন্দা বরদাচরন। যদিও তাঁর দুটোর বেশী গল্প আমি অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে পাইনি।) শবর আমি পরিনি, পড়ার ইচ্ছে আছে, কিন্তু যেখানে শবর-ট্রীলজি মুক্তি পেয়ে গেল, পি কে বাসুর একবার রূপোলি পর্দায় পুনরাগমনের সময় হল না, ভাবলে বড় দুঃখ লাগে।
পি কে বাসুর মত বঞ্চিত রইল জয়ন্ত-মানিক। হেমেন্দ্রকুমার রায় ছিলেন বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের

দিকপাল। ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা থেকে এম আর জেমস এর ছোটগল্প, তাঁর অগম্য স্থান কোথাও ছিল না। জয়ন্ত মানিক ছাড়া তাঁর আর একটি অ্যাডভেঞ্চার প্রেমী ডিটেকটিভ ডুয়ো আছ, বিমল-কুমার, যারা গতবছর ‘যখের ধন’-এর হাত ধরে সিনেমা হলে এসেছেন। যদিও সিনেমাটি ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স অ্যান্ড দি লাস্ট ক্রুসেড’-এর ফ্রেম বাই ফ্রেম কপি, তবুও… জয়ন্ত-মানিকও বাংলা সাহিত্যে বড়ই আন্ডারঅ্যাপ্রিশিয়েটেড বলে আমার মনে হয়।
যাই হোক। গোয়েন্দা নিয়ে লিখতে বসেছি, আর কালাপানি পেরোবো না, এ তো আর হয় না; তাই আসতেই হয় হোমস থুড়ি শার্লক সাহেবের কথায়; আমরা জানি, বহুলাংশে বাংলা বেশিরভাগ গোয়েন্দা চরিত্রই এনার ‘রিপ-অফ’। এমনকি ফেলুদাও। কিন্তু একটা জিনিস বলে রাখা ভালো, ফেলুদার বেশিরভাগ গল্পের ক্লাইম্যাক্সে সবাই কে এক ঘরে জড়ো করে রহস্যমোচনের সে ব্যাপারটা আমরা দেখি, সেটা কিন্তু আদোও হোমস-এর কায়দা নয়। এই বৈশিষ্টটা পুরোপুরি পাওয়া যায় এরকুল পোয়ারোর গল্পে। এই বেলজিয়ান ডিটেকটিভটি কে আগাথা ক্রিস্টির পর অমর করেছে ডেভিড সুচে-র অভিনয়। স্বীকার করছি, একটিও পোয়ারো কাহিনি আমার পড়া নেই। কিন্তু আমার কাছে পোয়ারো মানে ডেভিড সুচে। হয়তো অনেকেই জেরেমি ব্রেট এবং অবশ্যই বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ এর কথা বলবেন; ওনারা অনবদ্য, মেনে নিলাম। কিন্তু আমার কাছে ছোটপর্দার সেরা গোয়েন্দা হল পোয়ারো, এবং তার কারণ ডেভিড সুচে।
মিস মার্পল, ফাদার ব্রাউন, আরো হাজারটা গোয়েন্দা আছেন। কিন্তু আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে, পোয়ারোর পরে কে, তাহলে শার্লকের কথা মাথায় রেখেও আমি জবাব দেব, মাইকেল কনেলির ‘হ্যারি বশ’। হ্যাঁ, ইনি অপেক্ষাকৃত নবীণ, কিন্তু এনার গল্পগুলো আমার কাছে অ্যাপিলিং একটা কারণে। মাইকেল কনেলির লেখনশৈলী। ভদ্রলোকের লেখায় এতো নিপুন ভাবে মেডিক্যাল বা সার্জিক্যাল আঙ্গিকটা ফুটে ওঠে, গায়ে কাঁটা না দিয়ে যায় না। মাঝে মাঝে শিউরেও উঠতে হয়।
গোয়েন্দা নিয়ে যদি বলতে থাকি, এ লেখা অদূর ভবিষ্যতে কোথাও থামবে বলে তো আমার মনে হয় না, তাই আপাতত এখানেই যবনিকা টানলাম।
পরের সপ্তাহে দেখি আবার কতদূর পৌঁছনো যায়…
My Sarahah – neelotpals.sarahah.com
Soft copy de golper jogar kore… 😁😁
LikeLike