পূজো, সময়, আর ফ্যামিলি অ্যালবাম

বয়স বাড়ার সাথে সাথে, মানুষের কাছে সময়ের গতি বেড়ে যায়। কারণ, পরিস্কার বুঝতে পারি ছোটবেলায় পূজোটা অনেক লম্বা হত। শুরু আর শেষটা খুব সুন্দর করে বোঝা যেত। পূজোর মধ্যে একটা হার্টবীট বাড়িয়ে দেওয়া অনাবিল আনন্দ ছিল। আর পূজোটা শুরু হত ঠিক এইভাবে;

ভোরে ওঠার অভ্যাসটা আমার তখন ছিলই, আর বাবা একদিন হঠাৎই সকালে খুব উত্তেজিত হয়ে আমায় ডাকাডাকি শুরু করলে আবিস্কার করতাম ছাদের কর্ণারে রাখা শিউলি গাছের নীচে একরাশ তাজা ফুল পরে। গন্ধে ম ম করছে আশপাশ। অজান্তেই হেসে ফেলে বুঝতাম, ঢাকে কাঠি পড়ার দিন আর বেশী দূরে নেই।

Family
সময়-লম্ফ…

আগে বিশ্বকর্মা পূজোয় আকাশে ঘুড়ি দেখা যেত, আর ঘুড়ি ওড়াতে না পারলেও, ঘুড়ি ধরায় আমার উৎসাহের কোনো অন্ত ছিল না। প্রতি বিশ্বকর্মা পূজোর দিন খান ৪-৫ ঘুড়ি ধরে, সেগুলো প্রায় এক বছর ধরে জমিয়ে রাখার পর, অবশেষে ধুলোয় মাখামাখি হয়ে, ছিঁড়ে একাক্কার হয়ে তাদের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটত।

মনে আছে, ভোর ৪টের সময় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলা কেমন রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরন জাগাতো। আর রেডিও শুরু হওয়ার আগে বাবা স্নান সেরে ঘরে ধূপ জ্বেলে দিত। রেডিওর আওয়াজ আর ধূপের গন্ধ… এরকম পরিস্থিতির বর্ণণা দিতেই বোধহয় ইংরেজিতে ‘মেসমেরাইজিং’ কথাটার উৎপত্তি হয়েছে।

যাই হোক। মহালয়া হয়ে গেলেই দিদি বলত,

-“দেবীপক্ষ পড়ে গেছে, এবার আমরা যা ইচ্ছে করতে পারি…”

আর আমাদের যা ইচ্ছে করা মানে হল পড়াশোনা শিকেয় তুলে দিয়ে, পিঠে পিঠ দিয়ে পূজাবার্ষিকী

Didi
অন্য এক সময়ের কথা…

আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী বা শুকতারায় ডুবে থাকা। বাবা মা এসে পাড়া মাথায় না করলে সেই অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটত না। মহালয়ার পর সপ্তমী আসতে যেন এক যুগ লাগিয়ে দিত। এই এল, এই এল করে অবশেষে পাড়ার প্যান্ডেলে ঠাকুর আসত, চোঙা লাগিয়ে চালানো হত কিশোর কুমারের গান, আর ঢাকে পড়ত কাঠি। আমি আর দিদি তখন হাতে লিখে মেন্যুকার্ড তৈরী করতাম। সপ্তমী, অষ্টমী… রোজের। আর, একটা নয়, পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্য একটা একটা করে তৈরী হত সেই মেন্যু। মায়ের স্পেশ্যাল অকেশনের জন্য তুলে রাখা টেবলক্লথ পাতা হত টেবলে। সব মিলিয়ে খাবার ঘরটাকে একটা রেস্তরাঁসম মেকওভার দেওয়ার চেষ্টা করতাম আমরা; অনেকাংশে সফলও হতাম। আর মায়ের দায়িত্ব ছিল সেই মেন্যু মিলিয়ে মিলিয়ে সুস্বাদু খাবার তৈরী করে টেবলে সাজিয়ে দেওয়া।

Babai
আমি আর বাবাই…

বাড়ি সাজানো, আর বইয়ের পেছনে এত সময় দিতাম বলেই, পূজোয় ঠাকুর দেখতে যাওয়ার শখ খুব একটা ছিল না আমার। আসলে, বই মুখে গুঁজেই গোটা পূজোটা কাটিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতি ছিলাম আমি। তবে হ্যাঁ, পূজোয় ঠাকুর দেখতে না গেলে; স্কুলে গিয়ে সহপাঠীদের কাছে গল্প করব কিসের, পূজোর ছুটির পড়ে ? আর আমার বেরোনোর আর একটা বৃহৎ কারণ হল, টালা বারোয়ারির মেলার হাজার খানা দোকান, নাগরদোলা আমার বড় পচ্ছন্দের জিনিস ছিল। আর তাই, পূজোর কোনো এক বিকেলে কাকার সাথে ঠাকুর দেখতে বেরোতাম। ঠাকুর দেখা মানে হল আমার পাড়ার আশেপাশে যে কটা ঠাকুর আছে, সেগুলো গুনে গুনে দেখা, যাতে বলতে পারি স্কুলে গিয়ে, আমি এই অ্যাত্তগুলো ঠাকুর দেখেছি। ঠাকুর দেখার শেষে, মেলায় গিয়ে কিছু একটা কেনা; (শুধু নীজের জন্য নয়, আমার জন্য, দিদির জন্য, আমার পিসতুতো দিদি, বোনের জন্য) তারপর বাড়ি ফেরা, ঐ শুরু, আর ওই একদিনেই আমার তথাকথিত ‘প্যান্ডেল হপিং’ এর ইতি।

বাবা কোনকালেই পূজোর সময় বাড়ির বাইরে বেরোবার পক্ষপাতি নন, তার কাজ ছিল আমাকে সময় আসময়ে পূজাবার্ষিকী পড়ে শোনানো। কারণ নীজে বই ধরার আগে থেকেই, গল্প শোনার ভূত আমার মাথায় বসবাস করত। আর বাবার একটা দায়িত্ব ছিল। মানে যাকে বলে পেইনফুল ডিউটি; সেটা হল দশমীর দিন বিকেল বা একাদশীর দিন সকালবেলা থেকে কান ধরে আমাকে পড়তে বসানো; কোনো ওজর আপত্তি না শুনে।

মোটামুটি এই ছিল আমার পূজো; আমাদের পূজো…

তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেল। আজকাল কাকার সাথে পাড়ার পূজো দেখে মন ভরে না, আসলে শুধু আমিই তো বাড়িনি, বয়স বেড়েছে কাকারও। আমার বাবাই আজকাল হাঁটুর ব্যাথায় কাতরায়। প্যান্ডেল হপিং তো দূর, সাধারণ ওয়াকিং এও বেশ সমস্যা।

দুটো পূজোয় দিদি কাটাল মার্কিন মুলুকে, আর তাই উৎসাহভরে মেন্যুকার্ড তৈরী আর হল না। টেবিলও যে কে সেই রইল। আর এই বছর দিদি দিল্লীতে সংসার পেতেছে। দূর্গাপূজোর স্বাদ তাই মেটাচ্ছে নবরাত্রি আর দশেরা দিয়ে। মা ও তাই মেন্যুর অপেক্ষা না করে খাবার তৈরী করে। আগের মত আমিও তো আর রোজ রোজ বাড়িতে খাই না।

IMG_20170927_120254041
একালের পূজো…

বাবারও ডিউটি শেষ, পূজাবার্ষিকীটা নীজেই পড়ি, আর বিজয়ার পরের দিন থেকে নীজে নীজেই বই খুলে বসে পড়ি সেমেস্টারের তাগিদে। আর পাড়ার পাশেপাশের ঠাকুর ছেড়ে আমিও আজকাল কলকাতার নামি দামী পূজো প্যান্ডেলের গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে পড়ি। ঠিক ঠাকুর দেখার তাগিদে নয়, আড্ডা আর অনিয়মের সন্ধানে।

তাই আমার পূজোটা বদলে গেল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের গলায় আর সেভাবে গায়ে কাঁটা দেয় না; আলাদা শুই বলে ধুপের গন্ধটা নাক অবধি পৌছোয় না। আর মহালয়ার পরও ক্লাসে যেতে যেতে, পূজোর সেই লম্বা ব্যাপারটা আর নেই। আসে, চলেও যায়, আবার আসার প্রস্তুতিও শুরু হয়ে যায়। বছরের বিশেষ দিনের বদলে, পূজো আজকাল রুটিন হয়ে গেছে, সেই রুটিন, যেটা বছরে একবার রিপিট করে। সেই শিউলি ফুলের গন্ধ মাখানো নস্ট্যালজিয়া নয়…

যাই হোক, অনেক বেশী বকে ফেললাম আজ… শেষে বলি, প্রতি বছরের মত আবার আজ অষ্টমী; আর তাই বিগত সময়ের দীর্ঘশ্বাস এর বদলে, আগামীর শুভেচ্ছা দিয়ে লেখাটা শেষ করাই বাঞ্ছনীয়। সবার জন্য তাই রইল অনেক অনেক শারদ শুভেচ্ছা। পূজো খুব ভালো কাটুক, অনেক ভালো ভালো স্মৃতিতে ভরে উঠুক সবার জীবন, এটাই কামনা করি।

শান্তির আশায়…

নীল

Advertisement

2 thoughts on “পূজো, সময়, আর ফ্যামিলি অ্যালবাম

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.